বন্ধুত্বের সুত্র

দুঃখ ও আনন্দের মমতাপূর্ণ ভাগীদার ছাড়া জীবন এক বিরান মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই নয় । দার্শনিক এমারসন বলেছেন, একজন বন্ধু হচ্ছে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় মাস্টারপিস । এছাড়া "বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পোসিবল" এমন উক্তিও আমরা টিভিতে এয়ারটেল সিমের এডে দেখতে পাই । যাই হোক বন্ধুত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য কবি-দার্শনিক বা এয়ারটেলের এড দেখার কোন প্রয়োজন নেই । আপনার আনন্দে এবং দুঃখে আপনার পাশে কেও না থাকলে আনন্দ যেমন বহুলাংশে মাটি হয়ে যায়, তেমন দুঃখও সহজে হালকা হয় না । মানুষ যখন বেদনাভারাক্রান্ত হয়ে যায় তখন বন্ধুর কাছ থেকে সে প্রথম সান্তনা পায়, আর যখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে তখন এ আনন্দের খবর সে প্রথম বন্ধুকেই জানায় । বন্ধুত্বের সাথে যেহেতু আবেগের ব্যাপার জড়িত সেহেতু বন্ধুত্ব আনন্দের সাথে সাথে সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে । তাই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, বন্ধুর কাছ থেকে কতটুকু চাওয়া ও পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে ভুল বোঝাবুঝির বা সমস্যার পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে । বন্ধুত্ব কেমন হওয়া উচিত এ নিয়ে অনেক প্রচলিত ধারণা রয়েছে । এ ধারণাগুলো নিয়ে যদি আমরা একটু আলোচনা করি তাহলে দেখব বাস্তবতা আসলে ভিন্ন ।
ধারণা ও বাস্তবতার এই পার্থক্য পরিষ্কার হলে বন্ধুত্ব আরও স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে । বন্ধুত্ব সম্পর্কিত কয়েকটি প্রচলিত ধারনাকে বাস্তবতার আলোকে বিচার করলেই ব্যাপারটি আমাদের কাছে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে ।
ধারণাগুলো হচ্ছেঃ

(১) "ঘনিষ্ট বন্ধুরা একে অন্যের জীবনের সবকিছুতেই ভাগীদার হবে"
সাধারনভাবে এ ধারণা প্রচলিত হলেও আধুনিক নগরজীবনে এ ধারণা বাস্তবসন্মত নয় । অধিকাংশের কর্মজীবনের বন্ধু ও পারিবারিক বন্ধু ভিন্ন । আবার পড়শিদের সাথে যে বন্ধুত্ব তাও আলাদা । শখ বা আগ্রহের ভিত্তিতে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাও আলাদা । আবার ধর্মচর্চার বেলায় দেখা যায় সম্পূর্ণ আলাদা কারও সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে । জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব এক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা । কারন মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, জীবনের সব ব্যাপারে দুই ব্যাক্তির মধ্যে আগ্রহের মিল হওয়া খুব দুর্লভ ব্যাপার । এমনকি আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও এমন কিছু আগ্রহ ও শখ থাকতে পারে যেগুলোর সাথে আপনার আগ্রহের আদৌ মিল নেই । তাছাড়া সদানির্ভরযোগ্য বন্ধুত্ব কামনা, শিশুসুলভ নিরাপত্তাহীনতাবোধেরই প্রকাশ । একজন বন্ধুর উপর পুরোপুরি নির্ভরতা অনেক সময়ই দুঃখের কারন হতে পারে । অপরপক্ষে তাঁর সামাজিক পরিধি বাড়ানোর চেস্টা করলেই প্রথম পক্ষকে দুঃখবোধে পেয়ে বসতে পারে । তাই একক বন্ধুত্বের চেয়ে একাধিক বন্ধুত্ব সবসময়ই আবেগগতভাবে ভালো ।

(২) "সত্যিকারের বন্ধু মানে আজীবনের বন্ধুত্ব"
এ ধারণা সবসময় ঠিক নয় । ছোটবেলায় যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, শিক্ষাজীবনে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর তা অধিকাংশই হারিয়ে যায় । আবার বাসস্থান পরিবর্তনের কারনেও পুরনো বন্ধুত্বের জায়গায় নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় । কর্মজীবী মহিলাদের বেলায় এ ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট । কর্মজীবনে বা শিক্ষাজীবনে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়, কর্মজীবন বা শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে গেলে তখন বন্ধুত্বের আওতা পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারে । তবে এই ধরণের খন্ডকালীন বন্ধুকেও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কোন প্রয়োজন নেই । জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে প্রয়োজনীয় ও আনন্দদায়ক বন্ধুত্ব হতে পারে ।

(৩) "বিপরীত লিঙ্গের কারোর সাথে নিষ্কাম বন্ধুত্ব সম্ভব নয়"
এ ধারনা সবসময় ঠিক নয় । মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিপরীত লিঙ্গের সাথে নিষ্কাম বন্ধুত্বের ঘটনাও এখন প্রায়শই দেখা যায় । কোন পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন আগ্রহের বা উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে একটি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব হতে পারে । মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ ধরণের বন্ধুত্বকে কামবর্জিত রাখা কখনও কখনও বেশ কঠিন । যখন আপনি কারোকে পছন্দ করতে শুরু করেন এবং ব্যাক্তি হিসেবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন তখন তাঁর প্রতি যৌন অনুভূতিও সৃষ্টি হতে পারে । কিন্তু এ অনুভূতি অনুসারে যে কাজ করতে হবে এমন কোন কথা নেই । আপনি এই অনুভূতিকে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েও তা সীমার মধ্যে রেখে দিলে সমস্যা নাও আসতে পারে ।

(৪) "রক্ত পানির চেয়ে গাঢ় । বন্ধুত্বের চেয়ে আত্মীয়তা ঘনিষ্ট"
এ ধারনাও সবসময় ঠিক নয় । এমনও দেখা গেছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, বোনের সাথে বোনের চিন্তা-চেতনা কোন কিছুরই মিল নেই । এমনও দেখা যায় বিপদে পড়লে ভাই বোনদের বদলে বন্ধুই এগিয়ে আসে । কারন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পছন্দের ভিত্তিতে । আর আত্মীয়তা একে অন্যের সাথে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ । রক্ত পানির চেয়ে ঘন হতে পারে, কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধে গেলে আঠালো হয়ে অকেজো হয়ে যায় । তাই অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় বন্ধুরা বন্ধুদের যেভাবে বোঝে ও অনুভব করে আত্মীয়রা সেভাবে বোঝেও না অনুভবও করে না ।

(৫) "ভালো বন্ধু সমসাময়িক হতে হবে"
এ ধারনাও সবসময় ঠিক নয় । ২৬ বছরের যুবকের সাথে ৫০ বছরের বৃদ্ধের বন্ধুত্ব হতে পারে । আর এ বন্ধুত্ব অত্যান্ত পরিপূরক হতে পারে । দুই প্রজন্মের মধ্যে বন্ধুত্ব উভয়ের জন্য অতিরিক্ত কিছু সুযোগ এনে দিতে পারে । বয়স্ক বন্ধু তরুনের জন্য জ্ঞান, বুদ্ধি, পরামর্ষের উৎস হয়ে দাড়াতে পারে । আর তরুনের কাছ থেকে বয়স্ক পেতে পারে তারুণ্যের উদ্দীপনা ।

(৬) "বিপদে বন্ধুর পরিচয়"
অধিকাংশ সময়ই এ কথা ঠিক হতে পারে । তবে কখনও কখনও ব্যাতিক্রমও দেখা যায় । বিপদে বা দুঃসময়ে যে বন্ধুর মতো এগিয়ে আসে, অনেক সময়ই বিপদ কেটে গেলে বন্ধুত্বের সেই তীব্রতা থাকে না । কোন কোন মনোবিজ্ঞানী বলেন, দুঃসময়ের বন্ধুত্ব সুসময়েই ভেঙ্গে যায় । কারন সুস্থ বন্ধুত্ব দেয়া নেয়ার উপর নির্ভরশীল । বন্ধুরা পালাক্রমে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সহানুভূতি দেয় এবং নেয় । কিন্তু কোন কোন মানুষ সহানুভূতি দিতে চায়, নিতে চায় না । আবার কেও কেও অচেতনভাবে কামনা করে বন্ধু যে ভাবাবেগজনিত সমস্যা বা দুঃসময়ে পড়েছে তা অব্যাহত থাকুক যাতে সে ক্রমাগত সহানুভূতি বিলিয়ে যেতে পারে । তাই কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় বন্ধু যখন খারাপ মানসিক অবস্থা থেকে ভালো অবস্থার দিকে এগোতে শুরু করে তখন ওই 'ত্রাণকর্তা' বন্ধুটি নিজের অজ্ঞাতসারে সুপরিবর্তনকে স্যাবোটাজ করতে চেস্টা করে । লক্ষ্য একটিই - যাতে বন্ধুত্বের ধারা অপরিবর্তনীয় থাকে ।

(৭) "ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে"
এ ধারনাও ঠিক নয় । বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বন্ধুরা অনেক দূরে থাকে । ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাতের কোন সুযোগ নেই, দীর্ঘদিন পরে হয়তো দেখা হয় । কিন্তু দেখা হবার সাথে সাথে তাদের যে অন্তরঙ্গতার প্রকাশ ঘটে তা দেখে কেও মনে করতে পারে যে এরা সবসময়ই কাছাকাছি একসাথে আছে । যখন উভয়ে উভয়কে অনন্য মনে করে তখন দীর্ঘ বিচ্ছেদ সত্ত্বেও বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকে ।
বয়স বাড়লে নতুন নতুন বন্ধু পাওয়া যায় না । এ ধারনাও আসলে ঠিক নয় । বয়স বাড়ার সাথে সাথে নতুন নতুন বন্ধুত্ব সৃষ্টি হতে পারে । আবার সক্রিয় কর্মজীবন সমাপ্তির পরেও চমৎকার নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হতে পারে । বন্ধুত্ব সম্পর্কে এ ধারণা ও বাস্তবতাগুলো সামনে রাখলে এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে ।

পরিশেষে বজায় থাকুক সকলের বন্ধুত্ব এই কামনায় আজকের লিখা শেষ করছি । সকলে ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন । আবারও সময়-সুযোগ পেলে মনোবিজ্ঞানের আরও কিছু চমক নিয়ে হাজির হব আপনাদের সামনে ।

Post a Comment

0 Comments