তারার জীবনচক্র

রাতের আকাশের দিকে তাকালে অসংখ্য মিটি মিটি জ্বলতে থাকা আলোকবিন্দু দেখতে পাওয়া যায়। আবার দিনের বেলা সারা আকাশজুড়ে দাপট দেখাতে থাকা আমাদের সূর্য মশাই এই জ্বলার ক্ষেত্রে একাই একশ। রাতের তারা আর দিনের সূর্য যতই আলাদা মনে হোকনা কেন, এরা সবাই মূলত একই গোয়ালের গরু। আর যেই সূর্য তার লাল লাল চোখ রাঙিয়ে দাপট দেখিয়ে বেরায়, সে আবার এই গোয়ালে তেমন কিছুই না, মধ্যম আকারের গরু বলা চলে। আর এদের প্রত্যেকের জীবনের একটা চক্র আছে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
প্রথমে দেখি তারার জন্মের জন্য কি দরকার। খুব বেশি কিছু না, কেবল একগাদা হাইড্রোজেন গ্যাস। মহাশূন্যে এই জিনিসটা সবচেয়ে সহজলভ্য। কিন্তু গ্যাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে তো হবে না, সবগুলোকে একইসাথে থাকতে হবে। এই গ্যাসের ভান্ডার হল নীহারিকা। তারার আতুর ঘর (বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ম্যাটারনিটি ওয়ার্ড ও ভাবা যায়) হল এই নীহারিকা। এখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস মহাকর্ষের কারণে ঘনীভূত হতে শুরু করে। মহাকর্ষীয় পতনের কারণে গ্যাসপিন্ড ক্রমে কেন্দ্রের দিকে জড়ো হতে থাকে এবং এর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তারার জন্মের এই অবস্থাকে বলা হয় প্রোটোস্টার। এটি হল তারার শৈশব। তারার এই শিশুকাল প্রায় ১ কোটি বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
প্রোটোস্টার দশায় তারার তাপমাত্রা বাড়লেও এতে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয় না। এই তাপ মহাকর্ষীয় চাপের কারণে সৃষ্টি হয়। এই তাপমাত্রা যথেষ্ট উচ্চ (প্রায় কয়েক মিলিয়ন কেলভিন) হলে এতে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়। আবার এই বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ, গ্যাসের ঘনত্ব প্রভৃতি মহাকর্ষের বিরুদ্ধে একটি চাপের সৃষ্টি করে। এই উভমূখী চাপের ফলে নক্ষত্রটি একটি সাম্যাবস্থায় চলে আসে।
এই ফিউশন বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে হিলিয়াম তৈরী করে। বিক্রিয়া শুরুর পরে নক্ষত্রটি উজ্জ্বল হয় এবং এই অবস্থাকে বলা হয় ‘মূল-ধারার নক্ষত্র’। এটি তারার যৌবন, এ সময়ই এর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত হয়। এই যৌবনকাল বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এই দৈর্ঘ্য নক্ষত্রের ভরের উপর নির্ভর করে। আমাদের সূর্য্যিমামার ক্ষেত্রে এই পর্যায় স্থায়ী হবে ১০ বিলিয়ন বছর।
তারার এই বিশাল চুলা জ্বলতে জ্বলতে একসময় জ্বালানী অর্থাৎ হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যায়, তার বার্ধক্য উপনীত হয়। এসময় পুরো চুল্লী জুড়ে থাকে কেবল হিলিয়াম। এখন জ্বালানী শেষ মানে চুলা বন্ধ, তাপ উৎপাদন বন্ধ। ফলাফল, সাম্যাবস্থার বারোটা বেজে আবার মহাকর্ষীয় চাপ। এই চাপে চ্যাপ্টা হয়ে বেচারা হিলিয়াম উপায়ান্তর না দেখে সে নিজের মধ্যে ফিউশন ঘটানো শুরু করে। কিছু কম ভরের নক্ষত্রে এই ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয় হঠাৎ করে, যাকে বলা হয় ‘হিলিয়াম ফ্ল্যাশ’।
হিলিয়াম বিক্রিয়া করে আরো ভারি মৌল তৈরি করে। তারপর আবার তাদের মধ্যে বিক্রিয়া। এভাবে চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, বোরন, কার্বন তৈরি চলতে থাকে তারা ভিতর। কিন্তু এভাবে চলতে থাকা বিক্রিয়ার একটা শেষ পয়েন্ট তো থাকা উচিত যেখানে এই চেইন রিঅ্যাকশন বন্ধ হবে। সেই শেষ পয়েন্ট নির্ধারণ করার মাপকাঠি হল তারার ভর। সূর্যের চেয়ে ১.৪ গুণ পর্যন্ত ভারী নক্ষত্রের বিক্রিয়া শেষ হয় কার্বনে গিয়ে। কারণ কার্বন পোড়ার জন্য যে তাপমাত্রা দরকার তা তারা অর্জন করতে পারে না।
সূর্যের চেয়ে ১.৪ গুণের অধিক ভারী নক্ষত্রের আবার দাপট এখানেই শেষ হয় না। তারা বিক্রিয়া চালাতে চালাতে লৌহ পর্যন্ত যেতে পারে। এরপরের বিক্রিয়া চালানোর মত তাপমাত্রা তারা পায় না।
এত কাহিনীর পর তারা মূমুর্ষু পর্যায়ে চলে আসে প্রায়। তারপরও এই চুপসে যাওয়া কার্বন কিংবা লৌহ কেন্দ্র নিয়ে তারা শাহরুখ খান এর মত বলে ওঠে, “পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত”। এতো মহা চিন্তার ব্যাপার। বিক্রিয়া শেষ, তাও তারা মরে না কেন? একটু দূরদৃষ্টি দিয়ে অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে একটু বাইরে এসে দেখা যাক। এতক্ষণ তারার কেন্দ্রে চেইন বিক্রিয়া চলছিল। কিন্তু তার বাইরে একটা আবরণে তখনো সেই মান্ধাতার আমলের হাইড্রোজেন কিংবা হিলিয়ামের বিক্রিয়া চলছে। এই বিক্রিয়ার কারণে কেন্দ্রের কাহিনি শেষ হয়ে গেলেও বাইরের স্তর ঠিকই চকচক করছে।
তারার বাইরের স্তর কেবল জ্বলেই ক্ষান্ত দেয়নি্‌, সে ফুলে ফেপে দানবাকৃতি ধারণ করতে শুরু করেছে। এই পর্যায়ে তারার তাপমাত্রা বেশ কম থাকে, কিন্তু ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায় বহুগুণ। এই অবস্থাকে বলা হয় লাল দানব বা রেড জায়ান্ট। সূর্যের ক্ষেত্রে এটি ফুলে ফেপে প্রায় বৃহস্পতির কক্ষপথ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং এর স্থায়িত্ব হবে প্রায় একশ কোটি বছর।
সৌরভরের ১.৪ গুণ পর্যন্ত তারাগুলো এই পর্যায়ে এসে একটু ভদ্রতা দেখায়। এর কার্বন-সমৃদ্ধ কেন্দ্র ভেতরের দিকে চুপসে যেতে থাকে আর বাইরের দিকে এর গ্যাসীয় স্তর ফুলতে ফুলতে এক সময় মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়। এর গ্যাসীয় স্তরের অবশিষ্ট যা থাকে তা মিলে তৈরি করে একটি প্ল্যানেটারি নেবুলা। আর ভেতরের কেন্দ্র মহাকর্ষের চাপে ঘনীভূত হতে থাকে। এক পর্যায়ে এর মহাকর্ষীয় চাপ এবং একে ঠেকিয়ে রাখার জন্য ইলেক্ট্রন ডিজেনারেসি চাপ পরস্পর সমান হয়ে সাম্যাবস্থায় আসে। এর ফলে এটি পরিণত হয় একটি সাদা বামনে (হোয়াইট ডোয়ার্ফ)।
সৌরভরের ১.৪ গুনের বেশি ভরের নক্ষত্র এই পর্যায়ে এসে বদরাগী হয়ে যায়। ভেতরের কেন্দ্র চুপসানোর সাথে সাথে বাইরের স্তর একটা বিস্ফোরণের সাথে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরে। এই বিস্ফোরণই সুপারনোভা বিস্ফোরণ।
সৌরভরের ১.৪ থেকে ৩ গুণ পর্যন্ত ভরের নক্ষত্রসমূহের বিশাল ভরের কারণেই এদের চুপসানোর পরিমাণ, অর্থাৎ ঘনত্বে পরিমাণ বেশি হয়। এর গ্র্যাভিটি এত বেশি হয় যে এর প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন মিলে নিউট্রনে পরিণত হয় এবং নিউট্রন ডিজেনারেসি চাপ এর গ্রাভিটিকে ঠেকিয়ে রাখে। এর ফলে এর কেন্দ্র হয় নিউট্রনের আধার, যাকে বলা হয় ‘নিউট্রন স্টার’। এর ঘনত্ব এত বেশি হয় যে এর এক চামচ পরিমাণ পদার্থ পৃথিবীতে আনা হলে তার ভর হবে কয়েক টন।
এই নিউট্রন স্টারের মধ্যে একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র থাকে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে এর থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট সময় পর পর রেডিও ওয়েভ বিকিরিত হয়। এগুলো আসে ঠিক নির্দিষ্ট সময় পর পর, পালসের মত। তাই এসকল নিউট্রন স্টারকে ‘পালসার’ও বলা হয়।
সৌরভরের চেয়ে ৩ গুণের চেয়ে বেশি ভরের নক্ষত্রের ক্ষেত্রে মহাকর্ষের চাপ এত বেশি হয় যে নিউট্রন ডিজেনারেসি চাপও একে সাম্যাবস্থায় আনতে পারে না। কারও কথা না শুনার ফলে এর ভবিষ্যৎ হয় অন্যান্য অবাধ্য ছেলেমেয়েদের মতই অন্ধকার। মহাশূন্যের অথই জগতে এরাই হল কালো গর্ত বা ‘ব্ল্যাকহোল’। এদের মহাকর্ষ এত বেশি হয় যে আলোও এর ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। মহাশূন্যের মহাখাদক হয়ে সবকিছু গ্রাস করে নিতে থাকে এরা।
তারাগুলো মরে গেলেও এদের কাহিনি এখানেও শেষ হয় না। জীবনানন্দের জীবন আনন্দে উদ্ভাসিত এই তারারা পণ করে রাখে, ‘আবার আসিব ফিরে, অসীম মহাকাশের নীড়ে, পরিপূর্ণ আলোয়’। সেই ফেলে আসা নক্ষত্রের অবশেষ যা সুপারনোভার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল কিংবা প্ল্যানেটারি নেবুলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তাদের কাহিনি পুনরায় শুরু হয়। মহাজাগতিক ধ্বংসস্তুপে পুনরায় ঘনীভবন, তাপ উৎপাদন, ফিউশনের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন কাহিনী। এভাবেই কালের আবর্তন আর তারার বিবর্তনে মুখরিত হয়ে থাকে মহাশূন্য, আর নতুন সাসপেন্স রেখে যায় অনুসন্ধিৎসু মানুষের জন্য।

Food recipes you may like - 

Post a Comment

0 Comments