মহাবিশ্ব এবং আমরা

কত বিচিত্র প্রাণী বাস করে এই পৃথিবীর পৃষ্ঠে। একেক প্রাণীর একেক বৈশিষ্ট্য। কেউ অতিক্ষুদ্র, কেউ বা বিশালাকার, কোনটা শক্তিশালী-হিংস্র, কোনটা নিরীহ গোবেচারা টাইপ আবার কোনটা কোমল মায়াময়। পৃথিবীর এরকম বিপুল প্রাণ সম্ভারের মাঝে একটি প্রজাতি যারা সমস্ত পার্থিব প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে উদগ্রীব আর করার ক্ষমতা রাখে। সেই প্রজাতি হল ‘Homo Sapiens’ বা মানুষ।
এ রকম ক্ষমতাবান হওয়ার কারণ মানুষ ভাবতে পারে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। প্রশ্ন করতে পারে এবং এর উত্তর সন্ধান করতে পারে। সোজা কথায় মানুষ অনুসন্ধিৎসু। মানুষের অনুসন্ধিৎসুতার মাঝে প্রথম যে বিষয় গুলোর জন্য সবচাইতে বেশি তাগিদ অনুভব করে সেগুলোর মাঝে কয়েকটি হচ্ছে, প্রকৃতি তথা বিশ্বচরাচর সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষা, প্রকৃতিতে নিজেদের অবস্থান উপলব্ধি করার আকুলতা। আর এই সংক্রান্ত জিনিস গুলো।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এসব নিয়ে চিন্তা করছে, ভাবছে তার অস্তিত্ব নিয়ে আর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছে। এধরণের কৌতূহলের সূত্রপাত কবে থেকে সেটা বলা হয়তো এখন একেবারেই সম্ভব নয় তবে বলা যেতে পারে যখন থেকে আকাশের দিকে মানুষ কৌতূহলী তাকিয়েছে তখন থেকে। আদিম মানবরা শিকার আর খানা খাদ্যর শেষে বিশ্রাম নিমিত্তে আলসেমিতে বসে মাথার উপর আদিগন্ত বিস্তৃত চাঁদোয়ার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্য, চন্দ্রর চলাচল আর অসংখ্য আলোকবিন্দুর মতো জ্বলজ্বল গ্রহ নক্ষত্র দেখছে স্বাভাবিকভাবেই তখন থেকেই মানুষকে ওগুলো ভাবুক করে তুলেছে, দাড় করিয়ে দিয়েছে এসব কৌতূহলের সামনে, যার জন্য তাগিদ অনুভব করেছে এদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার।
যা হোক, এই বিশাল দিগন্তবিস্তৃত আকাশ, অসংখ্য নক্ষত্র অথবা ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি অথবা অনন্ত শূন্যাঞ্চলের এই মহাবিশ্বর প্রতিটি কোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের জীবনের এধরণের মৌলিক সব কৌতূহলের মীমাংসা।
এখন আমরা জানি, এ মহাবিশ্ব সত্যিকার অর্থেই বিশাল। আপাতভাবে এর বিশালতা অনুভব করা হয়তো সম্ভব নয়। মহাকাশের একেকটি গ্যালাক্সিতে আছে প্রায় ১০^১১টি নক্ষত্র। একেকটি গ্যালাক্সি হচ্ছে একেকটি নক্ষত্রপুঞ্জ। বহু নক্ষত্রর দলগত গুচ্ছ হচ্ছে গ্যালাক্সি। আর দৃশ্যমান মহাবিশ্বতে এরকম গ্যালাক্সিই আছে প্রায় ১০^১১টি। অর্থাৎ মোট নক্ষত্রের সংখ্যা হিসেবে আনলে হবে প্রায় ১০^১১ * ১০^১১ = ১০^২২ । এ সকল নক্ষত্রের অনেকেই সূর্যের চেয়েও আকারে বড়। কয়েকশো গুন বড়ও হতে পারে, ছোট আর মাঝারি সূর্যের মতোও অনেক আছে। এছাড়াও আছে গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, উল্কা, ধূমকেতু, নীহারিকা, আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ প্রভৃতি অনেক চমকপ্রদ বস্তু।

মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে। যার পর থেকে স্থান কালের প্রেক্ষিতে শুধুই প্রসারিত হয়ে চলেছে। যেহেতু প্রসারিত হয়ে চলছে তাই ধরে নেয়া হয় আদিতে এই মহাবিশ্বের সবকিছু ছিল একত্রে, অস্বাভাবিক ঘনীভূত কোন কিছু ছিল সেটা। এই বিন্দুবৎ অবস্থাটার নাম দেয়া হয়েছে ‘সিঙ্গুলারিটি’। যা থেকে বিকট কোন বিস্ফোরণে সব কিছু ছিটকে বেড়িয়ে আসে। অতি সরলীকরণ করে বললে বলা যায় এই বিস্ফোরণের ফলে যে সব বেড়িয়ে আসে তা হচ্ছে ‘এনার্জি’। যার একটা অংশ পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় পদার্থে তথা বস্তুতে অন্য অংশ হয় রেডিয়েশনে। অতঃপর অনেকটাই সুষম ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি করে মহাবিশ্ব। সুষম বণ্টন ব্যাপারটা সহজে চোখে ধরা পরে না তবে অনেক বড় স্কেলে তাকালে জিনিসটা ধরা পরে। এই সুষম বণ্টন ব্যবস্থাটার একটা গালভরা নাম আছে সেটা হল ‘কসমোলজিক্যাল প্রিন্সিপাল’। আর সমগ্র বিস্ফোরণের ঘটনাটার তাত্ত্বিক নাম ‘মহা বিস্ফোরণ’ বা ‘বিগ ব্যাং’।
তাত্ত্বিক ভাবে ধরে নেয়া হয় এই মহাবিস্ফোরণের পূর্বে প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল (মহাকর্ষ, তড়িৎ-চুম্বক বল, সবল নিউক্লীয় বল ও দুর্বল নিউক্লীয় বল) একত্রে ছিল। মহাবিস্ফোরণের ১০-১১ সেকেন্ডের মধ্যে এ বলসমূহ পৃথক হয়ে যায়। এসময় তাপমাত্রা ছিল অকল্পনীয় রকমের বেশি। বিস্ফোরণের পর স্থানের আবির্ভাব ও প্রসারণের সাথে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
বিশ্ব সৃষ্টির ১০০ সেকেন্ড পর প্রথম পরমাণু নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এগুলো ছিল মূলত হাইড্রোজেন বা ডিউটেরিয়াম এবং কিছু পরিমাণ হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। ৫ মিনিটের মধ্যেই বেশিরভাগ নিউক্লিয়াস গঠনের কাজ হয়ে যায়। কিন্তু তখনও তাপমাত্রা এত উত্তপ্ত থাকে (প্রায় ১০০কোটি কেলভিন) যে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের সাথে যুক্ত হয়ে নিরপেক্ষ পরমাণু গঠন করতে পারে না। আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমে পরমাণু গঠনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। এভাবে পরমাণুর সৃষ্টি হয়। এই পরমাণুগুলোর অধিকাংশই হাইড্রোজেন এবং ডিউটেরিয়াম, কিছু হিলিয়াম আর লিথিয়াম পরমাণু।
বিশ্ব সৃষ্টির পর পর কেবল এই সব হালকা মৌলই তৈরি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে এত সংখ্যক বৈচিত্র্যপূর্ণ মৌল এলো কোথা থেকে? সহজ উত্তর, ভারী সব মৌল তৈরি হয়েছে তারাদের তন্দুরে। হাইড্রোজেনের মতো হালকা মৌল গুলো মাধ্যাকর্ষণের জন্য একত্রিত হয়ে নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়। আমরা আকাশে যে উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখি তার সবকটিই একেকটি বিশালাকার চুল্লি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর জ্বালানি হল বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস, যার মহাকর্ষীয় পতনের কারণেই তৈরি হয় এই নক্ষত্রসমূহ। এই তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাসসমূহ নিউক্লীয় ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলসমূহ (মূলত হিলিয়াম) তৈরি করে। এরপর যখন সব হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যায় তখন হিলিয়াম পোড়া শুরু হয়। এভাবে হিলিয়াম আরও ভারি মৌল লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, বোরন, কার্বন প্রভৃতি তৈরি করতে থাকে।
আমাদের সূর্যের মত মাঝারি নক্ষত্রের সমাপ্তি ততটা বিচিত্র ময় নয় অন্যদের সাথে তুলনা করলে। অভ্যন্তরীণ উত্তাপে পুড়ে পুড়ে খুব ভারি মৌল তৈরি করার মত তাপমাত্রায় তারা পৌঁছাতে পারে না। কেন্দ্রে বিপুল পরিমাণ ‘কার্বন’এর মতো মৌল নিয়ে তারা পরিণত হয় ‘সাদা বামন’-এ।
কিন্তু সূর্যের চেয়ে প্রায় অধিক ভারি নক্ষত্রগুলোতে বিক্রিয়া এখানেই শেষ হয় না। কার্বন পুড়ে অক্সিজেন, এরপর ক্রমান্বয়ে নিয়ন, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার এবং সবশেষে লোহার মতো ভারী তৈরি হতে থাকে। লোহা পুড়িয়ে আরও ভারি মৌল তৈরি করার মত তাপমাত্রা আর তারা লাভ করতে পারে না। এদের সাধারণ পরিণতি হল নিউট্রন স্টার অথবা ব্ল্যাকহোল। তবে এই পরিণতির আগে অভ্যন্তরীণ সৃষ্ট ভারী পদার্থ মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয় ‘সুপারনোভা’ বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এই ছড়িয়ে পড়া পদার্থসমূহ থেকে আবার নতুন নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে পারে যেখানে তৈরি হয় আরও ভারি মৌলসমূহ। আমাদের সূর্য কিন্তু তেমনি ছিটকে পরা পদার্থ থেকে তৈরি হয়েছে। এজন্যই আমাদের পৃথিবীতে এত বিপুল সংখ্যক বৈচিত্র্যপূর্ণ মৌলের উপস্থিতি।
আমাদের চারপাশের সবকিছুই এসকল মৌল থেকে তৈরি। জীবনের মূল উপাদান DNA মূলত কার্বন জাত যৌগ। আমাদের সহ সকল প্রাণীর দেহের প্রধানত যেগুলো বিদ্যমান সে গুলো হল কার্বন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, নাইট্রোজেনের মতো প্রভৃতি মৌল সমূহ। নক্ষত্রের কেন্দ্রে সৃষ্টি এসকল মৌলই আমাদের জীবনের গঠন উপাদান। যেগুলো থেকে বিভিন্ন ধরণের বিবর্তনে আমাদের আবির্ভাব। তাই বলা যেতে পারে, আমাদের উৎপত্তি ‘স্টার ডাস্ট’ থেকে। আরেকটু আগ বাড়িয়ে চাইলেই বলা যায় আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান।

Post a Comment

0 Comments